ধনুষ্টংকার (Tetanus) একটি মারাত্মক ব্যাকটেরিয়াল রোগ যা সারা বিশ্বে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে মানুষকে আক্রান্ত করে থাকে। এটি Clostridium tetani নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট হয়, যা মানবদেহের স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে এবং মাংসপেশির অস্বাভাবিক সংকোচন ঘটায়। এই রোগটি সাধারণত কাটাছেঁড়া, ক্ষত, বা কোনো আঘাতের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। সঠিকভাবে চিকিৎসা না হলে ধনুষ্টংকার জীবনহানির কারণ হতে পারে। তবে এই রোগটি সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য।
ধনুষ্টংকার রোগ
ধনুষ্টংকারের কারণ:
Clostridium tetani ব্যাকটেরিয়া মাটিতে, ধুলায় এবং পশুদের মলে পাওয়া যায়। এই ব্যাকটেরিয়া অ্যানেরোবিক পরিবেশে বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ যেখানে অক্সিজেন নেই সেখানে এটি সহজেই বেঁচে থাকে। ব্যাকটেরিয়াটি শরীরে প্রবেশ করলে এটি একটি নিউরোটক্সিন (টেটানোস্পাসমিন) উৎপন্ন করে, যা স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে।
ধনুষ্টংকারের সংক্রমণের কারণগুলো হলো:
- অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাটা বা ক্ষত হওয়া।
- দূষিত বস্তু দ্বারা তৈরি আঘাত, যেমন পুরোনো পেরেক বা ধারালো বস্তু।
- পোকা বা প্রাণীর কামড়।
- অস্বাস্থ্যকরভাবে প্রসবের পর নবজাতকের গোড়ালি কেটে ধনুষ্টংকার হওয়া (Neonatal tetanus)।
- অস্ত্রোপচার, ইনজেকশন, বা কোনো মেডিকেল প্রক্রিয়ার সময় সঠিক জীবাণুমুক্ততা না থাকা।
ধনুষ্টংকারের লক্ষণ:
ধনুষ্টংকারের লক্ষণ সাধারণত ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ৩ থেকে ২১ দিনের মধ্যে দেখা দেয়। তবে, এই সময়কাল আঘাতের গঠন, স্থান, এবং রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে। ধনুষ্টংকারের প্রধান লক্ষণগুলো নিম্নরূপ:
- মাংসপেশির সংকোচন ও ব্যথা: ধনুষ্টংকারের প্রধান লক্ষণ হলো মাংসপেশির তীব্র সংকোচন ও ব্যথা। বিশেষ করে মুখ, ঘাড় এবং পিঠের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়।
- জো লক হওয়া (Trismus): এটি মুখের মাংসপেশির এমন এক অবস্থা যখন মুখ বন্ধ হয়ে যায় এবং মুখ খোলা যায় না।
- মুখে বিকৃত ভাব: ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত ব্যক্তির মুখে একটি অস্বাভাবিক বিকৃত ভাব দেখা যায়, যাকে “risus sardonicus” বলা হয়।
- গলা ও পিঠের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়া: ধনুষ্টংকারের ফলে গলার মাংসপেশি শক্ত হয়ে গলা বন্ধ হয়ে আসে, যার ফলে রোগী খাবার ও পানি গিলতে পারে না। এছাড়াও, পিঠের মাংসপেশি শক্ত হয়ে পিঠ বাঁকা হয়ে যায়।
- শ্বাসকষ্ট: শ্বাসতন্ত্রের মাংসপেশি সংকুচিত হলে শ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, যা শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে।
- জ্বর ও ঘাম: শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে এবং রোগীর প্রচণ্ড ঘাম হতে পারে।
- 7. উচ্চ রক্তচাপ এবং দ্রুত হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন: ধনুষ্টংকারে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় এবং হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুত হয়।
ধনুষ্টংকারের ধরণ:
ধনুষ্টংকারকে কয়েকটি ধরণের মধ্যে ভাগ করা হয়:
- সাধারণ ধনুষ্টংকার (Generalized Tetanus): এটি ধনুষ্টংকারের সবচেয়ে সাধারণ ধরণ, যা মাংসপেশির শক্ত সংকোচন এবং জ্বর সহ পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
- স্থানীয় ধনুষ্টংকার (Localized Tetanus): এই ধরণের ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত ব্যক্তির নির্দিষ্ট একটি অংশের মাংসপেশিতে সংকোচন হয়। এটি তুলনামূলকভাবে কম মারাত্মক তবে ক্ষেত্র বিশেষে সাধারণ ধনুষ্টংকারে রূপান্তরিত হতে পারে।
- নবজাতকের ধনুষ্টংকার (Neonatal Tetanus): প্রসবের সময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে নবজাতক এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এটি সাধারণত তখন ঘটে যখন নবজাতকের নাভি কাটা হয় অস্বাস্থ্যকর অবস্থায়।
ধনুষ্টংকারের চিকিৎসা:
ধনুষ্টংকার একটি গুরুতর রোগ, তাই দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো ধনুষ্টংকারের ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করা, স্নায়ুতে টক্সিনের প্রভাব কমানো এবং রোগীর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল করা।
- অ্যান্টিটক্সিন: ধনুষ্টংকারের নিউরোটক্সিনের প্রভাব কমানোর জন্য রোগীকে টেটানাস ইমিউনোগ্লোবুলিন (TIG) দেওয়া হয়। এটি টক্সিনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে স্নায়ুতন্ত্রকে রক্ষা করে।
- অ্যান্টিবায়োটিক: সংক্রমণ কমানোর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক যেমন পেনিসিলিন বা মেট্রোনিডাজল দেওয়া হয়। এটি ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে সহায়ক।
- মাংসপেশি শিথিলকারী ওষুধ: রোগীর মাংসপেশির সংকোচন কমানোর জন্য মাংসপেশি শিথিলকারী ওষুধ দেওয়া হয়।
- শ্বাস-প্রশ্বাস সহায়তা: শ্বাসকষ্ট হলে রোগীকে শ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়তা দেওয়ার জন্য ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হতে পারে।
- জীবাণুমুক্ত পরিচর্যা: আক্রান্ত অংশটি জীবাণুমুক্ত রেখে এবং প্রয়োজনে সার্জারির মাধ্যমে মৃত কোষ অপসারণ করা হয়।
ধনুষ্টংকার প্রতিরোধ:
ধনুষ্টংকার প্রতিরোধে সঠিক সময়ে টিকা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধনুষ্টংকার টিকার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। ধনুষ্টংকার টিকার সাধারণত তিনটি ডোজ দেওয়া হয়, এবং প্রতি ১০ বছর পর পর একটি বুস্টার ডোজ দেওয়া প্রয়োজন।
- ধনুষ্টংকার টিকা (TT টিকা): ধনুষ্টংকারের প্রধান প্রতিরোধক হলো ধনুষ্টংকার টিকা। শিশুদের জন্য এটি বাধ্যতামূলক এবং প্রাপ্তবয়স্করাও যেকোনো আঘাতের পর দ্রুত টিকা নিতে পারেন।
- আঘাতের সঠিক পরিচর্যা: কাটাছেঁড়া বা আঘাতের পর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতস্থানে প্রাথমিক চিকিৎসা করা উচিত। জীবাণুমুক্ত পদ্ধতিতে ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ লাগানো প্রয়োজন।
- সুরক্ষিত প্রসব ও নবজাতকের যত্ন: প্রসবের সময় এবং নবজাতকের নাভির যত্ন নেওয়ার জন্য সুরক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
ধনুষ্টংকার একটি গুরুতর রোগ হলেও এটি সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য। সঠিক সময়ে টিকা নেওয়া এবং আঘাতের সঠিক যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে ধনুষ্টংকার প্রতিরোধ করা সম্ভব। সচেতনতা বাড়িয়ে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার মৌলিক নিয়মগুলো মেনে চললে এই মারাত্মক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
আরো পড়ুন: